
জনাব আবদুল হামিদ ভূঁইয়া জাতীয় পর্যায়ের বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ‘সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস (এসএসএস)’-এর নির্বাহী পরিচালক। এসএসএস প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালনসহ বিগত প্রায় ৩৯ বছর যাবত তিনি সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৭০ সালে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ‘আশা’ এবং ‘ঢাকা আহছানিয়া মিশন’-এ ১০ বছরেরও বেশী সময় কাজ করেন। এসময়ে তিনি বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের দারিদ্র্য পীড়িত জীবনের নানা দিক সম্পর্কে সম্যক অবহিত হন এবং সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হন। কয়েকজন উদ্যোমী সহকর্মী এবং স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে তিনি টাঙ্গাইল জেলায় প্রতিষ্ঠা করেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস (এসএসএস)’।
সোসাইটি ফর সোসাল সার্ভিস (এসএসএস) ১৯৯২ সালে পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর সংস্থাটি প্রাথমিক পর্যায়ে টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত টাঙ্গাইল সদর ও মধুপুর উপজেলায় দুটি শাখা অফিসের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে সংস্থাটি স্থানীয় জনসাধারণকে সংগঠিত করে দল গঠনের মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের শিক্ষা উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। বর্তমানে সংস্থাটি ৭১২টি শাখা অফিসের মাধ্যমে ৫৫টি জেলায় নানাবিধ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এসএসএস-এর কার্যক্রমভুক্ত পরিবার সংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ। জনাব আবদুল হামিদ ভূঁইয়া-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এসএসএস বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয়-পর্যায়ে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে এসএসএস-এর অবদান এবং আবদুল হামিদ ভূইয়া-এর নেতৃত্বের ভূমিকা তরুণ উন্নয়ন কর্মীদের জন্য ভীষণ অনুপ্রেরণামূলক। পিকেএসএফ পরিক্রমার জন্য জনাব আবদুল হামিদ ভূইয়া-এর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন জনাব মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন শেখ, সহকারী মহাব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ এবং জনাব মো. ওয়ালিউল্লাহ্, সিনিয়র সহ. কর্মসূচি ব্যবস্থাপক, এসএসএস।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: এখন থেকে প্রায় ৩৯ বছর আগে কী প্রেরণা থেকে সোসাইটি ফর সোসাল সার্ভিস (এসএসএস) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি-পর্যায়ে নানামুখী কাজ শুরু হয়। বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও উদ্যোমী তরুণ/যুবারা মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দিরসহ অন্যান্য সামাজিক অবকাঠামোর সংস্কার, মেরামত ও পুনর্নিমাণে উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা স্থানীয়-পর্যায়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ ও উপকরণ সংগ্রহ করে। দাতা ও মহৎ ব্যক্তিদের নিকট আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করে। এসময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ কাজ করত মূলত: ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিয়ে।
১৯৮০ সালে আমি নব-প্রতিষ্ঠিত উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান: আশা-এ উপ-পরিচালক হিসেবে চাকরি শুরু করি। এই সংস্থায় আমার বেশকিছু অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। কিন্তু সমাজের নানান ধরনের বৈষম্য ও অনিয়ম আমাকে ভাবাতো। এভাবে সেখানে কেটে যায় তিনটি (১৯৮০-১৯৮২) বছর। এরপর আমি ১৯৮৩ সালে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনে উপ-পরিচালক হিসেবে যোগদান করি। ওখানেও আমি প্রায় সাত বছর কাজ করি। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনে কর্মকালীন সময়েও সমাজের নানা অনিয়ম ও বৈষম্য আমার অন্তরকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে সেসময় দেশের মধ্যে চলতে থাকে বহুবিধ রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, অশিক্ষা ও অশালীন কর্মকাণ্ড।
সে সময়ে আমার ভাবনায় চলে আসে দেশ ও সমাজের বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যার বিষয়সমূহ। ‘আশা’য় আমার সহকর্মী মির্জা সাহাদত হোসেন (‘সেতু-টাঙ্গাইল’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক) এবং ‘মৌচাক’ সংস্থার সাধন চন্দ্র গুণ (এসএসএস-এর অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক) আমরা তিনজন প্রতিদিন অফিস শেষে জাতীয় সংসদ-ভবনের দক্ষিণ দিকে একত্রিত হতাম। আমরা দেশ ও জাতির বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতাম। এক পর্যায়ে আমার একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির স্বপ্ন দেখি। আমরা সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে তাদের মধ্যে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যবহারিক শিক্ষা, পরিবারভিত্তিক উন্নয়ন, কুসংস্থার ও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, সুবিধাবঞ্চিত ও পথ শিশুদের উন্নয়ন ও শিক্ষার সম্প্রসারণ করার চিন্তা করি। আমরা চিন্তা করি আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হলে সমাজে সহজেই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। এভাবে ভাবনা আর চিন্তায় অতিবাহিত হলো: বছর দুয়েক।
১৯৮৬ সালের নভেম্বরে আমরা প্রতিষ্ঠা করি, সোসাইটি ফর সোসাল সার্ভিস (এসএসএস)। টাঙ্গালে সদরে আমার বাসায় অফিস নিয়ে কাজ শুরু করি। এরপর ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সমাজসেবা অধিদপ্তর হতে রেজিস্ট্রেশন লাভ করি। আমরা প্রথমদিকে ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তুলি। গুরুত্ব দেওয়া হয় পরিবারভিত্তিক উন্নয়নকে। একইসঙ্গে সুবিধাবঞ্চিত ও পথ শিশুদের উন্নয়ন ও শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু হয়। এরপর ১৯৯০ সালে সংস্থা এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন লাভ করে। মূলত ১৯৯০ সাল থেকেই এসএসএস-এর প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এরপর আমরা উপলব্ধি করি, আর্থিক পরিষেবা ব্যতীত উন্নয়ন সম্ভব নয়। অন্যান্য উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মতো আমরাও ১৯৯১ সাল থেকে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি। মূলধনের উৎস হিসেবে ছিল, কর্মীদের মাসিক চাঁদা এবং সদস্যদের সাপ্তাহিক সঞ্চয়।
১৯৯১ সালে এসএসএস-এর শাখা অফিস ছিল দুটি: টাঙ্গাইল সদর শাখা ও মধুপুর শাখা। সংস্থার তহবিল প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই সামান্য। সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এসএসএস-এর সম্পৃক্ততা ছিল বেশি। সে-সময়ে সামাজিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সংস্থাকে হাতেগোনা দু-একটি দাতা সংস্থা সহায়তা দিয়েছে। আমরা আর্থিক পরিষেবা কার্যক্রমের জন্য উল্লেখযোগ্য দাতা সংস্থা খুঁজতে থাকি। সাধারণ মানুষের অর্থের চাহিদা ছিল অনেক। ১৯৯২ সালে ২ সেপ্টেম্বর এসএসএস পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। পিকেএসএফ প্রাথমিকভাবে এসএসএস-কে একলক্ষ টাকা ঋণ হিসেবে বরাদ্দ দেয়। সার্ভিস চার্জ ছিল ২%। এসএসএস গৃহীত ঋণ গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণ খাতে বিতরণ করে। এরপর এসএসএস-এর সম্প্রসারণ পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে। চলমান এই অগ্রযাত্রায় বিভিন্ন চড়াই-উতরাই মোকাবেলা করে এসএসএস অতিক্রম করে তিন-যুগেরও বেশি সময়। আজ জাতীয়-পর্যায়ের অন্যতম নেতৃস্থানীয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে (শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পঞ্চম) রূপান্তর হয়েছে। একথা না বললে নয়, শুরুতে এসএসএস-এ কর্মরত কর্মীদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এই জটিলতা আমি সহনশীলতার সাথে সমাধন করেছি।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: বর্তমানে আপনাদের সংস্থার প্রধান কার্যক্রমগুলো কী কী?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: বর্তমানে এসএসএস-এর প্রধান কার্যক্রমসমূহ হলো:
আর্থিক পরিষেবা (ঋণ, সঞ্চয়, সুরক্ষা তহবিল, রেমিট্যান্স ট্রান্সফার), কৃষি-মৎস্য-প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, অপুষ্টি দূরীকরণের মাধ্যমে জাতি-গঠন (নেম), গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোগ সম্প্রসারণ (আরএমটিপি), পেস (গাভি পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, মুরগিপালন), স্মার্ট প্রকল্প, স্বাস্থ্যসেবা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও শিশু উন্নয়ন, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বন্যা (ইসিসিসিপি-ফ্লাড ও ড্রাউট), সামাজিক অবক্ষয় দূরীকরণ (যুব উন্নয়ন ও ভিক্ষাবৃত্তি দূরীকরণ), প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, গবেষণা ও প্রকাশনা, সামাজিক উন্নয়ন ও কল্যাণ, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও কৈশোর উন্নয়ন, অ্যাডভোকেসি ও নেটওয়ার্কিং প্রভৃতি কর্মসূচি ও প্রকল্প অগ্রগণ্য। উল্লেখ্য, এসএসএস সূচনা-পর্ব থেকে উন্নয়ন সদস্যদের বৃহত্তর কৃষি কার্যক্রমে অংশগ্রহণে অনুপ্রেরণা ও সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: আপনাদের সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবদুল হামিদ ভূঁইয়া: এসএসএস সূচনালগ্ন থেকেই শিক্ষা ও শিশু উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সংস্থা বর্তমানে শিক্ষা ও শিশু উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে এসএসএস-পৌর আইডিয়াল হাই স্কুল (সমাজের নিম্নবর্ণের অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের উন্নয়নের জন্য নির্মিত), সোনার বাংলা চিলড্রেন হোম (পতিতা পল্লির শিশু-কিশোরদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র), গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম, টিভিইটি (কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ) ইনস্টিটিউট, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও কারাতে কার্যক্রম এবং শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচির অধীনে প্রায় চার হাজার সুবিধাবঞ্চিত ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: পতিতা পল্লির শিশু-কিশোরদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে কোনো বাধার সম্মুখীন কি হয়েছেন? হয়ে থাকলে তা মোকাবিলা করে কি সাফল্য অর্জন করেছেন আপনারা?
আবদুল হামিদ ভূঁইয়া: এসএসএস সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের রয়েছে এক বড় ইতিহাস। সংস্থা ১৯৯৪ সালে সেভ দ্যা চিলড্রেন-অস্ট্রেলিয়ার আর্থিক সহায়তায় টাঙ্গাইল সদরের শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বে ও বটতলায় দুটি ড্রপ-ইন সেন্টার (শিশু বিকাশ কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করে। এই ড্রপ-ইন সেন্টারে উপকারভোগী ছিল: টোকাই, পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু কিশোর। এই ড্রপ-ইন সেন্টারে ৬০ জন শিশুকে সকাল ৯টা হতে বিকেল ৬টা পর্যন্ত পরিচর্যা করা হতো। এখানে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, খেলাধুলা, দুপুরে খাবার ও ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। একজন করে শিক্ষক প্রতিটি ড্রপ-ইন সেন্টার দেখাশুনা করতেন।
ড্রপ-ইন সেন্টার চালু হওয়ার ৩-৪ মাস পরে ৬০ জন ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকজন টিকে থাকলো। অনুসন্ধানে দেখা গেল অনুপস্থিত শিশুরা পতিতা ও হরিজন পল্লির শিশু। আর তাদের অনুপস্থিতির মূল কারণ সম্প্রদায়গত বিরোধ। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের শিশুদের গ্রহণ করতো না, পাশাপাশি বসতো না, কথাও বলতো না। এমন পারস্পরিক বৈরিতার অবসানের লক্ষ্যে পতিতাপল্লীর উত্তর পাশে খোলা জায়গায় গাছের নিচে পতিতাপল্লী ও নিম্নবর্ণের আনুমানিক ৫০-৬০ জন শিশু নিয়ে এসএসএস শিশু শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। সেখানে খোলা আকাশের নিচে গাছের তলায় একজন শিক্ষক সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে পাঠদান করতেন। শিশুদের উদ্দেশ্যে গল্প বলা হতো, কিছু ছবি ও অন্যান্য উপকরণের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হতো। সেখানে দুপুরে খাবার ব্যবস্থাসহ ইনডোর খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষক লেখাপড়া ও খেলার উপকরণগুলো বাক্সে ভরে রিকশায় করে নিয়ে আসতেন আবার বিকেল বেলায় বাক্স করেই অফিসে নিয়ে যেতেন। কিছুদিনের মধ্যে এখানেও একটি সমস্যা দেখা দিল। তা হলো: পতিতা পল্লির শিশুদের অন্যান্য নিম্নবর্ণের সম্প্রদায়ের শিশুরা দেখতে পারতো না, তাদের মেনে নিতে পারতো না। উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে ১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে সেখানে বটগাছের পাশে একটি টিনের ছাপরা ঘর তৈরি করে তাতে নিম্নবর্ণের সম্প্রদায়ের শিশুদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়। আর পতিতা পল্লির শিশুদের জন্য পতিতাপল্লীর পশ্চিম পার্শ্বে একটি বাড়ি ভাড়া করে পাঠদান করা হয়। এভাবে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে।
এসএসএস শিশু বিকাশ কেন্দ্রসমূহের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করাতে গেলে কোন স্কুল কর্তৃপক্ষই ভর্তি করতো না। এসময় টাঙ্গাইল দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেয়। তবে একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন যে সেখানেও ঐসব শিশুরা অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেনি। অন্যদিকে পতিতা পল্লির শিশুরা দিনের বেলায় যা শিখে তা পরের দিন ভুলে যায়। তখন এসএসএস-এর নিকট মনে হলো যে দূরে কোথাও তাদের নিয়ে যেতে হবে সেখানে একটি নিরিবিলি পরিবেশ বিরাজ করবে। এমন প্রেক্ষাপটে, ১৯৯৮ সালে আইএলও-এর আর্থিক সহায়তায় শিক্ষা কেন্দ্রটি স্থানান্তর করে টাঙ্গাইলের কোদালিয়ায় একটি ভাড়া করা বাড়িতে নেওয়া হয়।
কোদালিয়ায় ভাড়া করা বাড়িটির নাম দেওয়া হলো শাহানা সেফ হোম। শাহানা একটি মেয়ের নাম। যৌনপল্লির কর্দমাক্ত অন্ধকারে যার জন্ম হয়েছিল। শিশু থেকে শৈশব বা কৈশোর কেটেছে টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়ার যৌনপল্লীতে। বারো বছর বয়সী এই মেয়েটি ১৯৯৪ সালে এসএসএস-এর শিশু বিকাশ কেন্দ্রের একজন ছাত্রী ছিল। শাহানাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্যে এসএসএস নানাভাবে চেষ্টা নিয়েছিল। এসএসএস-এর চেষ্টা আর শাহানার প্রবল ইচ্ছাকে পাশ কাটিয়ে শাহানার মা তাকে তাদের আদিম পেশায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। শিশু বিকাশ কেন্দ্রে আর শাহানার বিকশিত হয়ে উঠার সুযোগ হলো না। মায়ের ইচ্ছার কাছে শাহানার আলেকিত হয়ে ওঠার জীবনে নেমে এলো অমানিশার ঘন অন্ধকার। শাহানাকে নিয়ে এসএসএস-এর স্বপ্ন অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেল। কিন্তু এই মেয়েটি এসএসএস-এর কাছে একটি আবেদন জানিয়েছিল। শাহানাদের মতো মেয়েদের জন্যে এসএসএস যেন একটি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে। যেখানে অন্ধকারের গলিতে জন্ম নেওয়া অসংখ্য শাহানাদের আশ্রয়স্থল হবে, সুযোগ হবে বিকশিত হওয়ার, সুযোগ পাবে অন্ধকারের গলি থেকে বের হয়ে আসার। এমন প্রেক্ষাপটে এসএসএস দাতা সংস্থা খুঁজতে থাকে। কেননা, সেফ দ্যা চিলড্রেন-অস্ট্রেলিয়ার ক্ষুদ্র অনুদানে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না।
১৯৯৮ সালে আইএলও-এর আর্থিক সহায়তায় টাঙ্গাইলের কোদালিয়ায় একটি ভাড়া করা বাড়িতে শাহানা সেফ হোমের কার্যক্রম চলতে থাকে। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি ঘটে। পতিতা পল্লির ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকবে, পড়ালেখা করবে তা ওখানকার বাসিন্দারা চাইতো না। তারা মনে করতো এইসব শিশুদের কারণে তাদের ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে। এসএসএস কর্তৃপক্ষ স্থানীয় জনসাধারণকে নানাভাবে বুঝিয়ে পতিতা পল্লির ৪০ জন ছেলেমেয়েকে শাহানা হোমে স্থানান্তর করে। সেখানে তাদের জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি পূর্ণ আবাসিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। অনেক বোঝানোর পরও স্থানীয় লোকজন পতিতা পল্লির ছেলেমেয়েদেরকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেনি। এমনকি মসজিদে পতিতা পল্লির ছেলেদের নামাজ পড়তে বাধা দেওয়া হতো। এরপর এসএসএস শাহানা হোমে আরবি শিক্ষার ব্যবস্থা করে। সেখানে নিয়মিত মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হতো। মিলাদ মাহফিল ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দাওয়াত দেওয়া হতো। এক পর্যায়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে হোমের শিশু-কিশোরদের সাথে একটা সুসম্পর্ক স্থাপন হয়। পরবর্তী সময়ে এই পতিতা পল্লির ছেলেরাই নামাজের জন্য আযান দিয়েছে এবং মসজিদের সকল কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে।
এরপর ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে টিডিএইচ নেদারল্যান্ড-এর অর্থায়নে পতিতাপল্লীর আরো বেশি সংখ্যক শিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কুইজ বাড়িতে ২৭ বিঘা জমিতে শাহানা সেফ হোম স্থানান্তর করা হয়। ৮০ জন শিশু এখানে সম্পূর্ণভাবে এসএসএস-এর তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করে। এসব শিশুদের থাকার জন্য এখানে তৈরি করা হলো তিন তলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন। এভাবে এসএসএস সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের পরিপূর্ণতা ঘটে।
বর্তমানে এই হোমে ৮৩ জন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তারা বিভিন্ন-স্তরে লেখাপড়া করছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সার্বিক দায়িত্ব এসএসএস পালন করছে। অন্যদিকে হোমের শিশু-কিশোরদের প্লে-গ্রুপ থেকে নার্সারি শ্রেণি পর্যন্ত হোমের ভিতরে স্থাপিত স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাধ্যমি শ্রেণি পর্যন্ত নিকটতম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে মাস্টারস পর্যন্ত বিভিন্ন কলেজ, কৃষি ডিপ্লোমা কলেজ, নার্সিং কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়।
এ পর্যন্ত এ হোমের ২৯ জন ছেলেমেয়ের সংস্থার অভিভাবকত্বে বিবাহ দেওয়া হয়েছে। মোট ৪২ জনের শোভন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরমধ্যে এসএসএস-এ চাকরি দেওয়া হয়েছে ২৪ জনের, ১৫ জন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ৩ জন এসএসএস-এর সহায়তায় স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত রয়েছে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে আপনারা কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে থাকেন?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে এসএসএস সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে সম্পৃক্ত। এ সকল ব্যক্তিদের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমরা বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের পর্দাপ্রথা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদেরকে সম্পৃক্ত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সংস্থার শুরুর দিকে এ ধরনের সমস্যা বেশ প্রকট ছিল। নারীদের ঘরের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। পুরুষদের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেওয়া হতো। তবে মাঠ পর্যায়ে সংস্থা দীর্ঘদিন কাজ করার পর বর্তমানে এ সমস্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ঋণ গ্রহণের পর ঋণের টাকা ফেরত দিতে সমস্যা সৃষ্টি করত। তারা মনে করে, উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহ বিদেশ হতে দাতা সংস্থার মাধ্যমে টাকা নিয়ে এসে ব্যবসা করে। এ টাকা আর ফেরত দিতে হয় না। এজন্য তারা টাকা ফেরত দিতে রাজি হতো না। বহু কষ্ট করে এদের নিকট হতে টাকা আদায় করতে হতো। সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষগণ উন্নয়ন সংস্থাকে অপছন্দ করে। এ সকল প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করে তাদেরকে তারা সম্মান দেয় না। অথচ এ সংস্থার কর্মীরা কত কষ্ট করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও যারা টাকার ব্যবহার জানেন না তারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে এ জাতীয় ব্যক্তিদের নিকট ঋণের টাকা আদায় করাও অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়। এছাড়াও এসএসএস সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় বাবার নাম চাওয়া হতো। বাবার নাম ও পরিচয় ছাড়া ভর্তি করা হবে না বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলত। সেক্ষেত্রে আমরা এসএসএস-এর বিভিন্ন কর্মকর্তা এবং আমার নাম দিয়ে হোমের ছেলেমেয়েদের ভর্তির ব্যবস্থা করে যাচ্ছি।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: যে-সব লোকজন আপনাদের সংস্থা থেকে সেবা গ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: এসএসএস সাধারণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সংস্থার উন্নয়ন-সদস্য ও সুবিধাভোগীগণ বাস্তবায়িত কার্যক্রম হতে বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে, নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কুসংস্কার ও সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তারা এখন অনেক সচেতন হয়েছে। আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন নিয়ে তারা প্রত্যেকে এখন চিন্তা করে। নিজেদের উন্নয়নের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। তারা প্রত্যেকে সঞ্চয় ও বিনিয়োগমুখী হয়েছে। অনেকে উদ্যোক্তা হয়েছে, স্ব ও মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। এ সকল উদ্যোক্তাগণ অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। উন্নয়ন-সদস্য ও সুবিধাভোগীগণ স্বাস্থ্য ও খাদ্য-পুষ্টি বিষয়ে সকলে সচেতন। তারা প্রত্যেকে বিশুদ্ধ পানি পান ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবহার করছে। তারা বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও নারী নির্যাতন বিষয়ে অনেক সচেতন। শিশুদের শিক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ে সকলে সজাগ ও সচেষ্ট। এছাড়াও সংস্থা হতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অনেক নারী জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে। তাদের আয় বর্ধনশীল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দক্ষতা ও সক্ষম উন্নয়ন হয়েছে। তারা নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী আবাসন ও রুচির পরিমার্জন ঘটিয়েছে। সংস্থা থেকে অনেক ব্যক্তি বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। সংস্থার শিক্ষা ও শিশু উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে অনেক পিছিয়ে পড়া ও পথশিশু সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সংস্থার শিক্ষা বৃত্তির মাধ্যমে অনেক গরিব মেধাবী ছেলে-মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। সংস্থার অনুদানে অনেকের বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণসহ উন্নয়ন ঘটেছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দুর্যোগে আক্রান্ত অনেক পরিবার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছে। অনেক কৃষক ও সাধারণ পরিবার সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি পরিষেবার মাধ্যমে কৃষি-মৎস্য-প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন করছে, স্থিতিশীল উদ্যোক্তায় রূপান্তর হয়েছে। তারা বিষমুক্ত ও জৈব পদ্ধতিতে খাদ্য-পুষ্টি উৎপাদনে অভ্যস্ত হচ্ছে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: টাঙ্গাইল একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। টাঙ্গাইলের চমচম ও তাঁত শিল্পের সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপি। এখানকার আনারসও খুবই প্রসিদ্ধ। এসব কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের সংস্থার কি কোনো বিশেষ উদ্যোগ আছে?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: এসএসএস সূচনালগ্ন থেকেই টাঙ্গাইলের চমচম উৎপাদনকারীদের আর্থিক পরিষেবা প্রদান করে যাচ্ছে। এই পণ্যটির উন্নয়নে সংস্থা গাভি পালন ও ডেইরি ফার্ম প্রতিষ্ঠায় প্রশিক্ষণ, কারিগরি ও আর্থিক পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সংস্থা ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্প ও PACE প্রকল্পের মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পিকেএসএফ ও নিজস্ব অর্থায়নে গাভি পালন, ডেইরি ফার্ম প্রতিষ্ঠা, গরুর ফিডের ও মেডিসিনের ব্যবসা ও দুধের বাজারের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। টাঙ্গাইল জেলার সিংহভাগ মিষ্টির ব্যবসায়ী এসএসএস-এর উন্নয়ন সদস্য।
তাঁত শিল্পের উন্নয়নেও এসএসএস-এর প্রত্যক্ষ অবদান বিদ্যমান। আমাদের সংস্থা থেকে আর্থিক ও কারিগরি পরিষেবা গ্রহণ করে অনেক তাঁত কর্মী তাঁতের মালিক হয়েছে, অনেকে বড় উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে। সংস্থা তাদের তৈরিকৃত তাঁতের পণ্যসমূহ জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন মেলা ও প্রদর্শনীতে প্রদর্শনের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে তাদের একটা বড় মার্কেট লিংকেজ তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে মধুপুরের গুণগতমানের আনারস উৎপাদনে এসএসএস-এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ভাল মানের এবং নিরাপদ আনারস চাষে এসএসএস চাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদান, কারিগরি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক পরিষেবা প্রদান করে যাচ্ছে। এসএসএস-এর সার্বিক প্রচেষ্টায় অনেক চাষি স্থিতিশীল উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে। এসএসএস সেপ, স্মার্ট-সহ আরও বেশকিছু প্রকল্প আনারস চাষ সম্প্রসারণ ও উদ্যোক্তা তৈরির জন্য মধুপুর অঞ্চলে বাস্তবায়ন করেছে। খামারিরা এসএসএস-এর প্রচেষ্টায় জৈব পদ্ধতিতে আনারসের চাষে অভ্যস্ত হয়েছে। সেখানে অনেক প্রদশর্নী খামার স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে মধুপুর অঞ্চলের চাষিগণ গুণগতমানের নিরাপদ আনারস চাষ করে যাচ্ছে। এছাড়াও আনারসের জুস, জেলি, চিপস ইত্যাদি পণ্য উৎপাদনে এসএসএস কারিগরি ও আর্থিক পরিষেবা প্রদান করছে। আনারসের বাজারের অবকাঠামোর উন্নয়ন ও বাজার সম্প্রসারণে এসএসএস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: এসএসএস ১৯৯২ সালে পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম বাস্তবায়নে পিকেএসএফ থেকে আপনারা কী ধরনের সহায়তা পেয়ে থাকেন?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: এসএসএস পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা পেয়েছে। পিকেএসএফ-এর বহুমুখী ঋণ কার্যক্রম, যেমন: জাগরণ, বুনিয়াদ, সুফলন, অগ্রসর, এমডিপি, এলআরএল ইত্যাদি ঋণ প্রোডাক্টসমূহ তৃণমূল স্তরে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করেছে। গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিতে হাজার হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। তৈরি হয়েছে স্ব-কর্মসংস্থান ও মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান। ফলে অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নীত হচ্ছে। পিকেএসএফ-এর বিশেষায়িত বিভিন্ন কর্মসূচি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছে। এরমধ্যে প্রাইম কার্যক্রমের আওতায় অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নমনীয় ঋণ প্রদান, কাজের বিনিময়ে অর্থ প্রদান, প্রশিক্ষণ প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাদের কর্মদক্ষতা ও মনোবৃত্তির ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পিএলডিপি, লিফ্ট, ফেডেক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ইউনিট, কৃষি ইউনিট, পেস, এসইপি, আরএমটিপি-সহ আরও বেশকিছু প্রকল্প কৃষি-মৎস্য-প্রাণিসম্পদ খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
পিকেএসএফ-এর সমৃদ্ধি কর্মসূচি দারিদ্র্য দূরীকরণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই কার্যক্রমটি সমন্বিত উন্নয়ন পদ্ধতিতে: অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক পরিষেবা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা, শিক্ষা ও শিশু উন্নয়ন, সামাজিক অবক্ষয় দূরীকরণ (ভিক্ষাবৃত্তি দূরীকরণ, যুবসমাজের উন্নয়ন), প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, পরিবেশ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। পিকেএসএফ-এর দুর্যোগ ঋণ (সাহস), সিসিসিপি ও বর্তমানে চলমান ইসিসিসিপি-ফ্লাড ও ড্রাউট কার্যক্রম দুর্যোগ মোকাবেলা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। একইসঙ্গে, ওবিএ স্যানিটেশন মাইক্রোফিন্যান্স প্রোগ্রাম সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। পিকেএসএফ-এর সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কর্মসূচি এবং শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রম সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও শিক্ষার সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে।
সার্বিক বিবেচনায় পিকেএসএফ মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর্থিক সহায়তা, অনুদান, প্রশিক্ষণ, মনিটরিং, প্রকল্প বাস্তবায়ন গাইডলাইন, বেসলাইন সার্ভে, প্রকল্প মূল্যায়ন, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজনের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের সক্ষমতা ও দক্ষতার উন্নয়নে অবদান রেখেছে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমে বৈচিত্র্যের পাশাপাশি সংস্থার মজবুত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও দক্ষ জনবল সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এসএসএস-এর সাফল্য রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জনে পিকেএসএফ থেকে কী ধরনের সহযোগিতা পেয়েছেন?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: এসএসএস সহযোগী সংস্থা হিসেবে পিকেএসএফ-এর নিকট বিভিন্ন স্তরে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ পেয়েছে। অনেক কর্মশালা, সভা ও সেমিনারে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছে। পিকেএসএফ-এর বিভিন্ন নীতিমালা ও পরামর্শ সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও নেতৃত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পিকেএসএফ, পিকেএসএফ-এর দাতা সংস্থা, পিকেএসএফ নির্দেশিত দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিগণের এসএসএস পরিদর্শন সংস্থাকে ধন্য করেছে। অর্জিত হয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা। এসএসএস ও পিকেএসএফ-এর দীর্ঘ পথ চলায় পরস্পরের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতের অমিল ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিকেএসএফ-এর রক্ষণশীলতা সংস্থার জন্য কষ্টকর হয়েছিল। তথাপি, দেশের আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি অর্জনে এই দুই প্রতিষ্ঠানেরই ছিল সম-অবস্থান ও বন্ধুত্ব।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: এনজিওগুলো দরিদ্র মানুষকে উপকারের চেয়ে শোষণ করে বেশি, এনজিও কর্তৃক বিতরণকৃত ঋণের সুদের হার বেশি, -এ ধরনের একটি সমালোচনা সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ মানুষের উপকারের চেয়ে শোষণ করে বেশি, এ ধরনের ধারণা ভুল ও নিছক মনগড়া। আমরা জানি ভাল কাজের সমালোচনা সর্বদাই থাকবে, এটা স্বাভাবিক। ঋণ বিষয়টি একটি জটিল প্রক্রিয়া। ঋণের টাকা যথার্থ বিনিয়োগ বা ব্যবহার করে লাভবান হতে পারলে ঋণ পরিশোধ সহজতর হয়। অন্যথায় ঋণের টাকা পরিশোধ খুবই কষ্টকর। মূলধারার আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকসমূহ যাদের আর্থিক সক্ষমতা ও জামানত দেওয়ার মত সম্পদ রয়েছে শুধু তাদেরকে ঋণ প্রদান করে। এক্ষেত্রে অনেক তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়। সময়ও লেগে যায় অনেক। অথচ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাসমূহ অতিসহজে জামানত ছাড়াই সমাজের গরিব থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে ঋণ দিয়ে থাকে। সংস্থাসমূহ বিশেষ যাচাই-বাছাই করে ঋণগ্রহীতা নির্বাচন করে। তথাপি, অনেকে গৃহীত ঋণ যথার্থ ব্যবহার না করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এটা সম্পূর্ণ ঋণ গ্রহীতার অদক্ষতার পরিচয়। ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাসমূহ আয়-বর্ধনশীল কর্মকাণ্ড পরিচালনা অথবা সম্পদ সৃষ্টি বা সম্পদ রক্ষা বা বিশেষ কোন যৌক্তিক চাহিদাপূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে। সংস্থাসমূহ সম্পূর্ণ জামানতবিহীন এই ঋণ প্রদান করে। অন্যদিকে ঋণ গ্রহীতা বা ঋণ গ্রহীতার প্রধান অভিভাবক মৃত্যুবরণ করলে আদায়যোগ্য ঋণ সম্পূর্ণ মওকুফ করে দেওয়া হয়। সদস্য এবং ঋণগ্রহীতাদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হয়, ফলে তাদের কারিগরি ও সক্ষমতার উন্নয়ন হয়। সদস্যদের মৃত্যুতে দাফন-কাফন বাবদ নগদ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সদস্যদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়, দুর্যোগ আক্রান্ত সদস্যদের ত্রাণ প্রদান করে, পুনর্বাসনে সহযোগিতা দান করে। পরিবারের সদস্যদের ব্যয়বহুল জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য অনুদান প্রদান করে। এভাবে যে-সকল সংস্থা মানুষের পাশে থেকে আর্থসামাজিক সহায়তা ও সহযোগিতা দান করে, তাদেরকে কি কোনোভাবে বলা যায় তারা সহায়তার চেয়ে শোষণ করছে বেশি? সুতরাং এই ধরনের মন্তব্য অবান্তর।
আবার অনেকের ভাসাভাসা ধারণা রয়েছে যে, ক্ষুদ্র ঋণ দানকারী সংস্থাসমূহের ঋণের সুদের হার বেশি। এক্ষেত্রে ভেবে দেখা উচিত যে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাসমূহ ব্যাংক বা অন্যান্য দাতা সংস্থা হতে একটা বড় অঙ্কের সুদের বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ করে। দাতা সংস্থা হতে গৃহীত ঋণ আবার সংস্থার উন্নয়ন-সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ছোট ছোট পরিমাণ টাকা অনেক ব্যক্তির মধ্যে বিতরণ করা হয়। এক্ষেত্রে সদস্যদের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে সেবা দেওয়া হয়। এর জন্য সংস্থাসমূহের প্রশাসনিক খরচ তুলনামূলক বেশি। তবে কম সুদে যদি এ সকল সংস্থা তহবিল সংগ্রহ করতে পারত তাহলে সুদের হার কমানো সম্ভব হতো। তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আমাদের দেশের মূল-ধারার ব্যাংকসমূহের অনেক ঋণের সুদের হার ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থার সুদের হারের প্রায় সমান। অন্যদিকে এ সকল ঋণ গ্রহণে নানাবিধ চার্জ ধার্য করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ বা ঋণের অংশ পরিশোধ করতে না পারলে অতিরিক্ত অনেক চার্জ ধরা হয়। যেমন আমাদের দেশের ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার বর্তমানে ২৫ শতাংশ। এছাড়াও এই কার্ডের বার্ষিক ফি-সহ রয়েছে নানান ধরনের চার্জ ও শর্ত। ব্যাংকসমূহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরূপ ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতাদের জেল জরিমানাও হয়।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আপনাদের সংস্থাসহ অন্যান্য এনজিওদের কী ধরনের ভূমিকা আছে বলে আপনি মনে করেন?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি অন্যতম বৃহৎ খাত। গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের কাছে অর্থ চলাচল হয় ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে। সমাজের যে-সকল পরিবার বা ব্যক্তি মূল-ধারার ব্যাংক হতে ঋণ নিতে পারেন না বা ব্যাংকের ঋণ গ্রহণের শর্ত পূরণ করতে পারেন না, তাদেরকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাসমূহ ঋণ প্রদান করে থাকে। গৃহীত এই ঋণের টাকা উন্নয়ন-সদস্যগণ বহুবিধ সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করে। এরমধ্যে সিংহভাগ ঋণ গ্রহীতা আয় বর্ধনশীল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ঋণ গ্রহণ করে। এর ফলে স্বকর্মসংস্থান ও মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের কৃষি-মৎস্য-প্রাণিসম্পদ খাতের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ ঘটছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন হয়েছে। প্রতিটি-স্তরে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়। এভাবে তারা গৃহীত ঋণ ব্যবহার করে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রেখে যাচ্ছে।
ঋণ গ্রহীতাদের একটা অংশ নিজেদের ব্যয়বহুল চিকিৎসা বা ছেলেমেয়ের বিয়ে বা লেখাপড়া বা অন্যান্য চাহিদা মেটানোর জন্য ঋণ গ্রহণ করে। অনেকে সম্পদ ক্রয় বা সম্পদ রক্ষার জন্য গৃহীত ঋণ ব্যবহার করে থাকে। এ জাতীয় ব্যক্তি বা পরিবারসমূহ যদি ঋণ গ্রহণের সুযোগ না পেত তবে অনেক সমস্যায় পতিত হতো। অনেকে সম্পদ হারাত, অনেকে বিনাচিকিৎসায় অসুস্থ হয়ে থাকতো বা মারা যেত, অনেকে সামাজিক মর্যাদা হারাত, অনেকের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া হতো না। অনেকে বেকার থাকত। ফলে দারিদ্র্যের হার অনেকগুণে বেড়ে যেত। গরিব পরিবারসমূহ আরও গরিব হতো।
অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাসমূহে (এমআরএ-এর লাইসেন্স প্রাপ্ত, পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা এবং এমআরএ-এর বহির্ভূত অন্যান্য কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স প্রাপ্ত সংস্থাসমূহে) পাঁচ লক্ষেরও বেশি কর্মী কাজ করে যাচ্ছে। এই সেক্টরটি জব মার্কেটের একটি বড় অংশ। একইসঙ্গে, এ জাতীয় সংস্থা হতে দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংস্থাসমূহ শিক্ষা সম্প্রসারণ ও সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির ফলে সমাজ হতে অনেক কুসংস্কার বিলুপ্ত হয়েছে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা-সহ অনেক সমাজিক সমস্যা হ্রাস পেয়েছে। সমাজে নারী ও পিছিয়ে-পড়া জন গোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়নে বড় ভূমিকা রয়েছে। সংস্থাসমূহের ত্রাণ ও পুনর্বাসনেও রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: এসএসএস-এ বিগত প্রায় ৩৯ বছরের কর্মজীবনে আপনার কি কোন অপূর্ণতা আছে? এমন কিছু কি আছে যা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু পারেন নাই? বা যেভাবে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবে হয় নাই?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: আমার একটা ইচ্ছা ছিল যে, প্রতিষ্ঠান ও সমাজে কোন বৈষম্য থাকবে না। বিশেষ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য শূন্যের কাছাকাছি অবস্থান করবে। অথচ বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ যত উন্নত হচ্ছে, বৈষম্য তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই বৈষম্যকে কেন্দ্র করে সমাজে ৮০ শতাংশ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে আরও একটি ইচ্ছা ছিল, আমাদের সংস্থার প্রত্যেকটি কর্মী সংস্থাকে নিজের প্রতিষ্ঠান ভেবে নিবেদিত থাকবে। সদস্যদের সাথে তাদের থাকবে উন্নয়ন-বিষয়ক নিবিড় সম্পর্ক। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সদস্যগণ কর্মীদের কাছে ছুটে আসবে। কর্মীগণ সার্বিক বিষয়ে তাদেরকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ইচ্ছা ৩০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে দেখা যায়, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থায় দক্ষ ও নিবেদিত কর্মীর ব্যাপক অভাব রয়েছে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: এসএসএস-এর আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবদুল হামিদ ভূইয়া: তিন-যুগ পেরিয়ে নব-যুগের সন্ধিক্ষণে এসএসএস। অতিক্রান্ত পথযাত্রায় সংস্থার লাভ হয় বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ সংস্থার মুখ্য সাধনা। সংস্থার ভবিষ্য অগ্রযাত্রার চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো:
নতুন ও সময়োপযোগী সেবা-পরিষেবার রূপায়ণ: এসএসএস সর্বদাই জনবান্ধব। সাধারণ জনগোষ্ঠীর চাহিদা এবং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেবা-পরিষেবার সংস্করণ ও বিভিন্নমুখী প্রোডাক্ট রূপায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রোডাক্ট ও পরিষেবা দেশে-বিদেশে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হবে। সমাজ ও সাধারণ মানুষের মঙ্গল-বর্ধনে এসএসএস দৃঢ় তৎপরতায় এগিয়ে যাবে।
সৃজনশীল ও সমন্বিত উন্নয়ন পন্থা: এসএসএস সুসমন্বিত নেতৃত্ব ও প্রশিক্ষিত জনবলের আধিকারী। বাস্তবমুখী সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসী। বর্তমানে সংস্থায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমন্বিত কর্মপন্থা অনুসৃত। অগ্রগামী এই নবধারা সার্বিক দক্ষতা বৃদ্ধি, অবচয় হ্রাস ও সমন্বিত উন্নয়ন ব্যবস্থা জোরদার করে যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে সংস্থা এ বিষয়ে আরও উদ্যমী ও বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করবে।
সেবা প্রদানকারী নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ: বহুসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে পরিষেবা প্রদান এসএসএস-এর একনিষ্ঠ মনোবাঞ্ছা। সময়োপযোগী পরিষেবা ডিজাইন সংস্থার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। পরিষেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সমাজের কল্যাণ সম্প্রসারণে সংস্থা সর্বদাই গতিশীল। আগুয়ান এই ধারায় সংস্থা পরিচালিত হচ্ছে। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে সংস্থার ১,৫০০টিরও বেশি শাখা পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও মানবতার উন্নয়নে এসএসএস কাজ করার স্বপ্ন দেখে।
ত্রিমাত্রিক উন্নয়ন অবলম্বন: এসএসএস শুধু জনবান্ধব নয়। বরং সমাজ, আর্থিক অবস্থা ও পরিবেশ-বান্ধব সংস্থাও বটে। সংস্থা প্রতিষ্ঠা-লগ্ন থেকে ত্রিমাত্রিক উন্নয়ন কলাকৌশল চর্চায় আবদ্ধ। বর্তমানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থিতিশীল করতে সমাজ, আর্থিক অবস্থা ও পরিবেশকে এক ফ্রেমে বিবেচনায় আনা হচ্ছে। আর্থিক মুক্তি ও অন্যান্য বিষয়ে সমৃদ্ধি অর্জনে ত্রিমাত্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া বর্তমানের হাল ফ্যাশন। এ বিষয়ে সংস্থার ভবিষ্যৎ পথচলা আরও সুদৃঢ় হবে।
নিবেদিত মানবসম্পদ, দক্ষতা ও ডিজিটালাইজেশন: বিপ্লব ও বিভাজন উন্নয়নের গতিপথ সম্প্রসারিত করে। এক্ষেত্রে মানবসম্পদ মূল নিয়ামক। ক্রমোন্নতির গতিশীল ধারায় সংস্থা মানবসম্পদকে দক্ষ ও নিবেদিত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সংস্থা ইতোমধ্যে কর্মসম্পাদন ও পরিষেবা প্রদানে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে। তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক প্রোডাক্ট প্রবর্তনের কথাও ভাবছে। আগামী দিনগুলোতে সংস্থায় নিবেদিত মানবসম্পদ সৃষ্টি, দক্ষতা ও সক্ষমতার উন্নয়ন এবং ডিজিটালাইজেশন ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পাবে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: আপনার প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরের উন্নয়ন কর্মীদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
আবদুল হামিদ ভূইয়া: এসএসএস-সহ সকল উন্নয়ন কর্মীদের নিকট আমার পরামর্শ হলো: গ্রাহক বা সদস্য, নিজের এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন বিষয়ে সকলের সম্যক ধারণা থাকতে হবে। এর জন্য নিজের থেকে উন্নয়ন-বিষয়ে লেখাপড়া করতে হবে। অন্যদিকে সুযোগ-সুবিধা ও সময়সীমা চিন্তা না-করে প্রত্যেককে স্বেচ্ছাসেবক হতে হবে, সময়ের যথার্থ ও উত্তম ব্যবহার করতে হবে। ফলে সমাজ ও নিজের উন্নয়ন সম্ভব হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব নির্ভর করে তার কর্মীবাহিনী ও সংগঠিত সদস্য/উপকারভোগীদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্কে উন্নয়নের উপর। প্রতিষ্ঠানের অর্জিত অর্থ অলস না রেখে ২/৩ গুণ (Two or Three Times) ব্যবহার করার মনোবৃত্তি অর্জন করতে হবে। প্রতিটি-স্তরে কর্মীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কর্মীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
পিকেএসএফ পরিক্রমা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সুস্বাস্থ্য ও সাফল্য কামনা করছি।
আবদুল হামিদ ভূইয়া: দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত দেশ গঠনে পিকেএসএফ ও এসএসএস-এর অগ্রযাত্রা চলমান থাকুক। পিকেএসএফ-এর সংশ্লিষ্ট সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।