জনাব মনোয়ারা বেগম বিগত প্রায় ৪২ বছর যাবৎ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের স্বনামধন্য বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ‘প্রত্যাশী’-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে একটি ছোট্ট পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে প্রত্যাশী’র যাত্রা শুরু হয়।

প্রত্যাশী ১৯৯৫ সালে পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। ‌বর্তমানে সংস্থাটি ১৪২টি শাখা অফিসের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১৪টি জেলার ৯৩টি উপজেলা/পৌরসভায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। সংস্থার বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় সংগঠিত পরিবার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ লক্ষ। ‌প্রত্যাশী’র প্রতিষ্ঠা এবং সাফল্যে জনাব মনোয়ারা বেগমের নেতৃত্বের ভূমিকা তরুণ উন্নয়ন কর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক। পিকেএসএফ পরিক্রমা’র জন্য জনাব মনোয়ারা বেগমের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোঃ মিনহাজ উদ্দিন শেখ এবং মাসুম আল জাকী

পিকেএসএফ: আপনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন ১৯৮৭ সালে; তার প্রায় ৪ বছর আগেই ১৯৮৩ সালে প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠা করলেন; শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার আগেই সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করার প্রেক্ষাপট আসলে কেমন ছিল?

মনোয়ারা বেগম: আমি জন্মেছিলাম চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার একটি ছোট গ্রাম, কানাইমাদারিতে। গ্রামের সেই শান্ত-সরল পরিবেশেই আমার শৈশব কেটেছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই আমার বিয়ে হয় বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল এলাকার এক শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন পরিবারে। সে সময়ে আমার বয়স কম হলেও, স্বপ্ন দেখার সাহসটা ছিল প্রবল। বিয়ের পর আমি যখন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি, তখন আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন, বিশেষ করে আমার স্বামী ও শাশুড়ি, আমাকে আন্তরিকভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে স্বামী ও শাশুড়ির সে উৎসাহ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলোর মধ্যে একটি।

আমার স্বামী যখন একজন প্রগতিশীল বাম রাজনীতিবিদ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন, প্রতিদিনই আমাদের বাড়িতে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আসতেন, কেউ নিজেদের সমস্যা নিয়ে, কেউ বা সমাজের নানা অসংগতির কথা বলতে। এই প্রতিদিনকার দৃশ্য, আর আমার বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে গ্রামের অসহায় মানুষগুলোর মুখে অভাব-অভিযোগের গল্প শুনে আমার মন কেমন করে কেঁদে উঠত। মনে হতো, এভাবে চুপ করে থাকলে চলবে না। কিছু একটা করতে হবে ওদের জন্য।

এ চিন্তা থেকেই ১৯৮০ সালে আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকায় ‘আকুবদন্ডী মহিলা সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি। উদ্দেশ্য ছিল নারীদের ক্ষমতায়ন আর তাদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। সেজন্য প্রথম ধাপে গ্রামের নারী ও কিশোরীদের সংগঠিত করে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমি ছিলাম সেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।

তখনই প্রথম মনে হয়েছিল, মানুষের পাশে সব সময় থাকাটা যেন আমার দায়িত্ব। শুধু ক্ষণিকের দান-সহযোগিতা নয়, চাই দীর্ঘমেয়াদি, সংগঠিত কিছু; যা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিতে পারবে। এই চিন্তাভাবনা থেকেই জন্ম নেয় ‘প্রত্যাশী’ নামের সংগঠনের ধারণা।

আমার বাবাও দীর্ঘদিন এলাকায় চেয়ারম্যান ছিলেন। ছোটোবেলা থেকে তাঁকে দেখেই মানুষকে সাহায্য করার ইচ্ছে, নেতৃত্বের সাহস আর জনসেবার মানসিকতা তৈরি হয়েছে আমার ভেতরে। সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ যেন আমার রক্তে মিশে আছে। এই প্রবল ইচ্ছা শক্তিই মূলত : প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা জোগায়।

আজ প্রত্যাশী কেবল একটি সংগঠন নয়, এটা আমার স্বপ্ন, আমার দায়বদ্ধতা, আমার জীবনের একটা বড় পরিচয়। জীবনের অনেক বাধা-বিপত্তির মাঝেও আমি যেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি না কেন, সমাজের অবহেলিত মানুষগুলোর মুখের হাসিই আমার সবচেয়ে বড় প্রেরণা।

 

পিকেএসএফ: আপনার এই স্বপ্নের সংগঠন ‘প্রত্যাশী’ প্রতিষ্ঠার পেছনে আর কোনো ব্যক্তির উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা কি ছিল; যা আপনি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে চান?

মনোয়ারা বেগম: ‘প্রত্যাশী’ প্রতিষ্ঠার পেছনের প্রেরণা ছিলেন আমার স্বামী, মরহুম সৈয়দ জালালউদ্দিন। জীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি ছিলেন আমার সাহসের উৎস, আমার আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি। প্রতিকূলতা যতই এসেছে, তাঁর নিরন্তর সমর্থন আমাকে পথচলায় অবিচল থাকতে সহায়তা করেছে। তিনি কেবল পাশে ছিলেন না, বরং আমার প্রতিটি স্বপ্নকে তিনি নিজের স্বপ্ন হিসেবে ধারণ করতেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে, এগিয়ে যেতে কিংবা প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে, সবখানে তিনি ছিলেন আমার একান্ত সহচর। আমি বিশ্বাস করি, নারীর নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত সক্ষমতার পাশাপাশি; পরিবার, বিশেষ করে জীবনসঙ্গীর সহযোগিতা ও সহানুভূতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিজের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রিয়জনদের ভালোবাসা ও সমর্থন মিলিয়ে গড়ে তুলেছি ‘প্রত্যাশী’-র মতো একটি স্বপ্নমঞ্চ।

 

পিকেএসএফ: পরিবার পরিকল্পনার মতো একটি পরিচিত বিষয় নিয়ে আপনারা কাজ শুরু করেছেন; কিন্তু পরবর্তীতে যখন অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরে কাজ শুরু করলেন, তখন কি ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন?

মনোয়ারা বেগম: আমি যখন ১৯৮৩ সালে সংগঠনের ব্যানারে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে বার্তা দিতে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারীদের সংগঠিত করছিলাম, তা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। আমার চলার পথ খুব একটা সহজ ছিলনা। তৎকালীন সময়ে নারীরা পর্দার বাইরে যাবে তা ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো। গ্রামের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার-সব মিলিয়ে কাজ করা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল। তারা স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা, পরিবার পরিকল্পনা বা মাতৃসেবার মতো বিষয়গুলো নিয়েও খুব একটা খোলামেলা আলোচনা করতে চাইতো না। আমি যখন বাড়িতে বাড়িতে ঘুরছিলাম তখন সমাজের সকল স্তর থেকে বাধাগ্রস্ত হয়েছি।  বেশ কিছু লোক বিশেষ করে ধর্মীয়ভাবে অন্ধ ফতোয়াবাজরা আমাকে এমনকি খ্রিষ্টান হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল এবং আমি নারীদের সংগঠিত করে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করছি বলে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে। তবুও আমি ধৈর্য আর মনোবল নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছি। পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন আমি কখনো থেমে থাকিনি। ধীরে ধীরে আমি তাদের মধ্যে সচেতনতার বীজ বুনতে পেরেছিলাম। তারা যখন দেখল আমাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য কার্যক্রম তাদের পরিবারের ও সমাজের উপকারে আসছে-তখন তারা দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে শুরু করলো।

কাজ করতে করতে এক সময় উপলব্ধি করি-সচেতনতা তৈরি করাই যথেষ্ট নয়; মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না করতে পারলে তারা নিজেদের অধিকারও পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবে না। এই ভাবনা থেকেই আমি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু করি, যাতে নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং সামাজিক পরিবর্তনের অংশীদার হতে পারে। কিন্তু নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে গিয়েও অনেক বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছে। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করায় সমাজের কিছু লোক আমাকে হুমকিও প্রদান করেছে। কিন্তু যখন বাস্তবিক অর্থে নারীরা আমাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেলাই কাজ, হাঁস-মুরগী পালন বা ছোট দোকান শুরু করে আয় করতে লাগলো- তখন ধীরে ধীরে সমাজও বদলাতে শুরু করলো। এই পরিবর্তন সহজ ছিল না, অত্যধিক ধৈর্য ও সময়ের সঙ্গে তা সম্ভব হয়েছে।

পিকেএসএফ: পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটটি কি ছিল?

মনোয়ারা বেগম: আমরা যখন নারীদের আয়মূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করি, তখন বিভিন্ন দিক থেকে প্রচুর বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। সমাজের অনেকেই নারীদের এসব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ভালোভাবে নেননি। তবুও, ১৯৯০ সালে সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপ (বর্তমানে পিকেএসএফ-এর একটি সহযোগী সংস্থা) থেকে একটি ক্ষুদ্র অনুদান পেয়ে আমরা চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় স্বল্প পরিসরে সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করি। আমাদের জনবল ছিল বেশ অনভিজ্ঞ, এবং কার্যক্রম চলত প্রায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। কার্যক্রমের পরিসর বৃদ্ধির জন্য অন্য কোনো উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল আামদের।

আমরা ১৯৯৫ সালে পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা হওয়ার জন্য আবেদন করি। এরপর পিকেএসএফ-এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক জনাব মোঃ ফজলুল কাদের মহোদয় (বর্তমানে পিকেএসএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক) বোয়ালখালীতে এসে আমাদের কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন এবং পরে লিখিতভাবে আমাদেরকে পিকেএসএফ-এর মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করার জন্য পরামর্শ প্রদান করেন।

আমরা সেই অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রমে মানোন্নয়ন করি এবং পিকেএসএফ-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখি। ছয় মাস পর তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক জনাব বিজয় চৌধুরী আমাদের কার্যক্রম আবারও পরিদর্শন করেন। তিনি আমাদের কার্যক্রম ও কার্যক্রমের গুণগত মান দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায়, পিকেএসএফ ৩১/০৫/১৯৯৫ তারিখে আমাদেরকে সহযোগী সংস্থা হিসেবে নির্বাচিত করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি প্রদান করে। এই অর্জন আমাদের জন্য শুধু স্বীকৃতি ছিল না, বরং এটি আমাদের ভবিষ্যৎ কাজের অনুপ্রেরণাও জুগিয়েছে।

আমি এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি পিকেএসএফ-এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব এম.এ.এম জিয়াউদ্দিন মহোদয়কে। তিনি নিজ অফিস কক্ষে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ১ লক্ষ টাকার চেক আমার হাতে তুলে দেন এবং সংস্থার সাফল্য কামনা করে দোয়া করেন, যা আমার চলার পথের পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে।

পিকেএসএফ: পিকেএসএফ থেকে আপনারা কি ধরনের সহায়তা পেয়ে থাকেন?

মনোয়ারা বেগম: পিকেএসএফ এর সাথে মানব উন্নয়নের অনেকগুলি কম্পোনেন্ট নিয়ে কাজ করে প্রত্যাশী। পিকেএসএফ এর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পাশাপাশি বর্তমানে সমৃদ্ধি কর্মসূচি, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, কৈশোর কর্মসূচি ও বিডি রুরাল ওয়াশ কর্মসূচি মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়াও পিকেএসএফ-এর প্রশিক্ষণ সেলের মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাগণ বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং কর্মক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করে থাকেন। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের কাজের গুণগতমান বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মাঠপর্যায়ে টেকসই কার্যক্রম বাস্তবায়নে উপকৃত হচ্ছি।

পিকেএসএফ: আপনাদের সংস্থা সুসংহতকরণের ক্ষেত্রে পিকেএসএফ-এর কী অবদান সম্পর্কে কিছু বলুন।

মনোয়ারা বেগম: পিকেএসএফ ও প্রত্যাশী’র সম্পর্কটি আমার কাছে কেবল দাতা ও গ্রহীতার মধ্যকার নয়; বরং এটি অনেকটা অভিভাবক ও সন্তানের মতো। শুরু থেকেই পিকেএসএফ আমাদের পাশে থেকেছে, যেন একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে পরম যত্নে লালন পালন করে বড় করে তোলা হয়। আমি সবসময়ই পিকেএসএফ-কে শুধুমাত্র একটি অর্থায়নকারী সংস্থা হিসেবে দেখিনি; বরং এই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের পথচলার প্রতিটি ধাপে ছায়ার মতো সঙ্গ দিয়েছে। প্রত্যাশীর ভিত মজবুত করতে পিকেএসএফ যে অবদান রেখেছে, তা সত্যিই অসামান্য।

এক সময়ের একটি আঞ্চলিক ছোট সংগঠন ‘প্রত্যাশী’ আজ জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজেদেরকে পরিচিত করে তুলতে চাই। এই দীর্ঘ যাত্রায় পিকেএসএফ কেবল অর্থায়ন করেই থেমে থাকেনি; তারা আমাদের প্রতিনিয়ত দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে এবং মাঠ পর্যায়ে কাজের পদ্ধতি হাতে-কলমে শিখিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, কার্যনির্বাহী পরিষদ পরিচালনা সর্বোপরি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিভিন্ন পলিসি তৈরিতে তারা আমাদের সহযোগিতা করছে। তাদের মনিটরিং, সুপারভিশন, কারিগরি সহায়তা ও গাইডেন্স আমাদের কাজের মান, কর্মীদের দক্ষতা এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এক বিশাল অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি বরং বলব, পিকেএসএফ আমাদের জন্য একটি প্রশিক্ষণাগার, একটি জীবন্ত পাঠশালা।

পিকেএসএফ: ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনে কীভাবে ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?

মনোয়ারা বেগম: দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম একটি কার্যকর পদ্ধতি হলো ক্ষুদ্রঋণ। ক্ষুদ্রঋণ এমন একটি আর্থিক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী জামানত ছাড়া ক্ষুদ্র অঙ্কের ঋণ নিয়ে আয়মূলক কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে নারী গ্রাহকদের সংখ্যা ৯০ শতাংশের বেশি, যাদের একটি বড় অংশ ক্ষুদ্র ব্যাবসা, সেলাই, কৃষি, পশুপালন ইত্যাদির মাধ্যমে আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে পরিবারে খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ায়, যা সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এর ১৭টি অভিষ্ট অর্জনেই ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরটি অবদান রেখে যাচ্ছে।

তবে আমি বিশ্বাস করি, ঋণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত না হলে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব স্থায়ী হয় না। অনেক সময় ঋণের অর্থ ভোগের পেছনে ব্যয় করে ঋণগ্রহীতা ঋণের বেড়াজালে আটকা পড়েন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন। দারিদ্র্য বিমোচনে এটিও সচেতনভাবে মাথায় রাখতে হবে।

পিকেএসএফ: ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতায়ন কীভাবে সম্ভব?

মনোয়ারা বেগম: ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম আমাদের সমাজের নারীদের জন্য একটি শক্তিশালী পরিবর্তনের হাতিয়ার। এর মাধ্যমে নারীরা নিজ উদ্যোগে ছোটোখাটো ব্যবসা শুরু করে নিজের এবং পরিবারের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে, যা তাদের সামাজিক অবস্থানকে আরো বেশি সুদৃঢ় করে।

ক্ষুদ্রঋণ শুধু অর্থ প্রদান নয়, এটি নারীদের ক্ষমতায়নের একটি সার্বিক প্রক্রিয়া। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে একজন নারী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শেখার সুযোগ ও নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ পেয়ে থাকে। এতে করে নারী আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের ও নিজের জীবনের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী ও সক্রিয় অংশীদার হয়ে ওঠে।

পিকেএসএফ: অনেকে অভিযোগ করেন যে ক্ষুদ্রঋণের সুদ হার অনেক বেশী; এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

মনোয়ারা বেগম: ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ক্রমশ কমছে। ২০১০ সালে সুদের হার ছিলো ২৭ শতাংশ; ২০১৯ সালে তা নেমে এসেছে ২৪ শতাংশে। ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয় তুলনামূলক বেশি, ঋণগ্রহীতাদের ঝুঁকি বেশি এবং ক্ষুদ্রঋণের বিতরণের জন্য নিজস্ব তহবিলের পরিমাণ কম ও ব্যবস্থাপনার খরচ অনেক বেশি। তা ছাড়া ক্ষুদ্রঋণের উদ্বৃত্ত সার্ভিস চার্জ শুধু অধিক মাত্রায় ঋণ কার্যক্রমে পুনঃব্যবহার না করে অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উন্নত বাসস্থান, স্যানিটেশন ইত্যাদি সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে করে সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে দাতা নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক ক্ষেত্রগুলোতে কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সাহায্য করছে। বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) কর্তৃক নির্ধারিত হারে সুদ আদায় করছে। তবে আমি মনে করি, সামনের দিনগুলোতে সব ক্ষেত্রে টেকসহিতা নিশ্চিত করতে পারলে সুদহার আরো কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

পিকেএসএফ: আপনাদের সংস্থা থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও কিছু সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। রোহিঙ্গা শিবিরে কার্যক্রম পরিচালনায় আপনাদের অভিজ্ঞতা কেমন? রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আপনার কি কোনো সুপারিশ আছে?

মনোয়ারা বেগম: কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আবাসনের শুরু থেকেই প্রত্যাশী মানবিক দৃষ্টিকোণ ও দায়বদ্ধতার প্রেক্ষিতে দাতা সংস্থার অর্থায়নে বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুরক্ষা, জীবিকায়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, স্যানিটেশন ও হাইজিন, কিশোর ও যুব উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা সেবা সেবা প্রদান করছি। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন: IOM, WFP, UNFPA এবং জাতীয় ও  আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা যেমন: হেলভেটাস, আইআরসি, অক্সফাম ও ব্রাক-এর সহযোগিতায় শরণার্থী শিবিরে প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনই সবচেয়ে বড় সমাধান। এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারসহ আন্তর্জাতিক সকল মহলের অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও বেগবান করার প্রয়োজন রয়েছে। এসবের পাশাপাশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে ততদিন তাদের জন্য শরণার্থী শিবিরে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে একটি টেকসই জীবিকায়নের ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে; যাতে করে তারা এই অর্থায়ন সংকোচনের মধ্যে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করে টিকে থাকতে পারে।

পিকেএসএফ: বিগত প্রায় ৪২ বছরে প্রত্যাশী পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনি কি কখনও কোনো বড় ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন? কীভাবে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন?

মনোয়ারা বেগম: প্রত্যাশী তখনো পিকেএসএফ এর সহযোগী সংস্থা হিসেবে নির্বাচিত হয়নি। সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপের অনুদানে মাঠপর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কাজ করার একপর্যায়ে সংস্থার ঘূর্ণায়মান তহবিল থেকে কিছু উদ্বৃত্ত তহবিল সৃষ্টি হয় যার পরিমাণ আনুমানিক ২৪ লক্ষ টাকা হবে। ঐ সময় সংস্থার প্রথম সারির একজন কর্মকর্তা আমাকে প্রস্তাব দেয় যে, আমরা যেন এই উদ্বৃত্ত টাকা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিই। তার এই কথা শুনে আমি তখন যারপরনাই মর্মাহত হয়েছি। কেননা আমি ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য নয় বরং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠা করেছি। এই প্রতিষ্ঠান আমার কাছে আমার সন্তান সমতুল্য। তাই প্রতিষ্ঠানকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার এই পরিকল্পনায় আমি সহমত হতে পারিনি। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমার অনাপত্তিতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠানের দরজায় তালা লাগিয়ে দেন। সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা আমি আজও ভুলতে পারিনি। অফিসের বাইরে একটি চেয়ারে বসে আমি সারারাত কাটিয়েছি; কিন্তু তার সাথে কোনো আপোশ করিনি। আমি জানতাম সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকলে আমাকে কেউ হারাতে পারবে না। পরবর্তীতে আমার স্বামী, কার্যনির্বাহী পরিষদের কতক সদস্য এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় আমি আমার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানকে অর্থলোভী সেই ব্যক্তির হাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছি। সেদিনের সেই স্বল্প উদ্বৃত্ত আজকের প্রায় ৫০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।  

পিকেএসএফ: আপনি তো সমাজ উন্নয়নের বহুরকম কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন, কোন কাজটি আপনাকে বেশী সন্তোষ প্রদান করেছে?

মনোয়ারা বেগম: দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই আমি প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠা করি। আমি স্বপ্ন দেখেছি, বৈষম্যহীন একটি সমাজের, যেখানে নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই নিজের মর্যাদায় বাঁচবে, সম্মানে চলবে। আমি চেয়েছিলাম নারীরা আর্থিকভাবে ক্ষমতায়িত হবে এবং পরিবারের ও নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিজেরাই নিতে সক্ষম হবে, তাদের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। এই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করে যাচ্ছি বিগত ৪২ বছর ধরে। সমাজ উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রেই কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তবে সত্যি বলতে কি- আমার সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্টি মেলে তখন, যখন দেখি প্রত্যাশীর কর্মসূচির সাথে সম্পৃক্ত সদস্যরা আজ স্বাবলম্বী হয়েছে, তারা আজ আর কাঁচা ঘরে নয়, পাকা ঘরে বাস করছে। তাদের সন্তানরা স্কুলে যায়, সময়মতো চিকিৎসাসেবা নিতে পারছে, পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো নিজেরাই পূরণ করতে পারছে; সর্বোপরি সামাজিক নানা ইস্যুতে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদের জীবনমান উন্নয়নে আমি পরিশ্রম করে যাচ্ছি, তাদের হাসিমাখা মুখ আর আত্মবিশ্বাস আমাকে আনন্দ দেয়, আবেগে আপ্লুত করে তোলে। আমি বিশ্বাস করি, উন্নয়ন শুধুমাত্র কোনো সংখ্যাগত বিষয় নয়, প্রকৃত উন্নয়নের চিত্র উঠে আসবে পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর আত্মমর্যাদায় বেঁচে থাকার গল্পে।

পিকেএসএফ: আপনার জীবনের এমন কোনো স্মরণীয় কি মুহূর্ত আছে; যা আপনাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করে?

মনোয়ারা বেগম: স্মরণে রাখার মতো অনেক ঘটনাই আমার জীবনে রয়েছে। তবে যে মুহূর্তটি কখনোই ভোলার নয়, তার সাথে পিকেএসএফ-এর যোগসূত্রতা রয়েছে। আপনারা জেনে থাকবেন, প্রত্যাশী পিকেএসএফ-এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নে সমৃদ্ধি ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এলাকাটি প্রত্যন্ত ও সন্ত্রাসপ্রবণ অঞ্চল। হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি, মারামারি, চুরি, ডাকাতিসহ নানাধরণের অপরাধ ছিল কালারমারছড়ার নিত্য দিনের ঘটনা। কালারমারছড়ার বাস্তবতা জানার পরও পিকেএসএফ-এর অনুরোধে, বিশেষ করে পিকেএসএফ-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ-এর অনুরোধে আমরা সেখানে কাজ শুরু করি। আমি একজন নারী হয়েও নানান প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে, সাহসিকতার সহিত নতুন এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে কালারমারছড়া ইউনিয়নে সমৃদ্ধি কর্মসূচির নানা কম্পোনেন্ট বাস্তবায়ন শুরু করি। যার মধ্যে ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, ওয়াশ, ভিক্ষুক পুনর্বাসন, রাস্তাঘাট, কালভার্ট নির্মাণ ও মেরামতসহ একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। এসব কর্মকাণ্ডকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া ও কর্মসূচির সফলতা নিয়ে ২০১৩ সালে আমরা কালারমারছড়ায় সমৃদ্ধি মেলার আয়োজন করি। উক্ত মেলায় পিকেএসএফ-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেলা প্রশাসক, এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

কালারমারছড়ার যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটি ছিল একবারেই চলাচলের অনুপযোগী। পিকেএসএফ-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সহায়তায় ঢাকায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করে রাস্তাটি মেরামত করার ব্যবস্থা করি। পরবর্তীতে ঐ রাস্তাটি স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে প্রত্যাশী’র রাস্তা হিসেবে পরিচিতি পায়। সেদিনের মেলার বিশাল আয়োজন ও সমৃদ্ধি কর্মসূচি সাহসিকতার সহিত বাস্তবায়নের জন্য আমার আগ্রহ ও সাহসের প্রশংসা করে পিকেএসএফ এর তৎকালীন চেয়ারম্যান মহোদয় আমাকে বেগম নূরজাহান উপাধি দেন এবং সংস্থার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন ও পরবর্তী পথ এগিয়ে যাওয়ার জন্য শুভকামনা জানান। একই সাথে পিকেএসএফ-এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় আমার সাহস, একাগ্রতা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের সফলতা দেখে প্রত্যাশী’র প্রশংসাস্বরূপ ধন্যবাদপত্র প্রদান করেন। তাঁদের সেই দিনের সেই প্রশংসা ও উপাধিকে আমি আজও হৃদয়ে ধারণ করি এবং যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নুরজাহান এর মতোই সাহস ও দৃঢ় মনোবল রাখার উৎসাহ পাই। যত বাধা বিপত্তি এসেছে আমরা তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি। সেদিনের কালারমারছড়া আর আজকের কালারমারছড়ার মাঝে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এক সময়ের অনগ্রসর ও সন্ত্রাস কবলিত জনপদ আজ সমৃদ্ধির ছোঁয়ায় উন্নয়নের স্রোত ধারায় ধাবিত হচ্ছে। যার প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করি।  

পিকেএসএফ: আপনি ২০০২ সালে ‘Prime Minister’s Award’ লাভ করেছেন, ঐ পুরস্কার অর্জন আপনার কোন কাজের স্বীকৃতি ছিল?

মনোয়ারা বেগম: প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মা ও শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনায় বিশেষ অবদানের জন্য জাতীয় পুরস্কার গ্রহণের মুহূর্তটি ছিল আমার জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়। এই পুরস্কার প্রাপ্তি ছিলো আমাদের বহু বছরব্যাপী সংগ্রাম, ত্যাগ আর অবিচলতা থেকে জন্ম নেওয়া সাহসের একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি। আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করি, তখন চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই শুরুর দিনের দৃশ্য। তখন আমরা কর্ম এলাকায় প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি পরিবারে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা ছড়াতে শুরু করি। এই স্বীকৃতি আমার একার ছিলো না, এটি প্রত্যাশীর প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক এবং সেইসকল সাহসী নারীদের সম্মিলিত অর্জন-যারা আমাদের উপর আস্থা রেখেছেন, আমাদের পাশে থেকেছেন সর্বদা।

এই পুরস্কার আমাদের জন্য যেমন গর্বের তেমনি দায়িত্বেরও। আমি সেই মুহূর্তে অনুভব করেছিলাম- আমাদের পথ সঠিক ছিল, তবে কাজ এখনো শেষ হয়নি। এই সম্মান আমাদের আরো অনেক দূর যাওয়ার শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছে।

পিকেএসএফ: বাংলাদেশে নারীর সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতায়নের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কী বলে আপনি মনে করেন?

মনোয়ারা বেগম: নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের রোল মডেল হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। নারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি সারা বিশ্বে আজ প্রশংসিত। ঘরে-বাইরে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ অনেকাংশে নিশ্চিত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতা প্রমাণ করছেন, কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন, নেতৃত্বও দিচ্ছেন। তবে নারীর পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায়ন অর্জনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া সম্ভব নয়। সরকারি উদ্যোগ হিসেবে প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে নারীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার উপর। এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নারীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

অন্যদিকে বেসরকারি সংগঠনগুলো নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, আত্মবিশ্বাস গড়া ও সামাজিক নিরাপত্তা ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও ঋণের জোগান দেয়, পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক সহায়তাও প্রদান করে। আমি মনে করি, নারীদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ও নেটওয়ার্কগুলোকে শক্তিশালী করাও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য জরুরি।

পিকেএসএফ: প্রত্যাশী-এর আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলুন।

মনোয়ারা বেগম: আমার স্বপ্ন, প্রত্যাশী শুধু জাতীয় নয়- আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। প্রযুক্তি, ইনোভেশন, ক্লাইমেট অ্যাকশন, জেন্ডার জাস্টিসসহ উন্নয়নের সকল সেক্টরে কাজ করবে। প্রত্যাশী’র তিনটি মূল দর্শন আছে- ‘মানবিকতা, অংশগ্রহণ ও ন্যায্যতা’ এই তিনটি বিষয়কে ধারণ করে পরবর্তী প্রতিটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে প্রত্যাশী হবে এমন একটি উন্নয়ন সংস্থা, যার সফলতার বার্তা পৌঁছে যাবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে।

পিকেএসএফ: আপনার প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরের উন্নয়ন কর্মীদের জন্য আপনার কি পরামর্শ আছে?

মনোয়ারা বেগম: ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরে কর্মরত উন্নয়নকর্মীগণ বাস্তবিক অর্থে অনেক পরিশ্রমী। তারা রোদ-ঝড়-বৃষ্টি সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে দিনরাত মানুষকে সেবা দিয়ে থাকে। তারাই মূলত আমাদের সম্মুখ সারির সৈনিক। ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরটি দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তাই আমি মনে করি, এই সেক্টরে যারা কাজ করছেন তারা একটি মহান কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তাই উন্নয়নকর্মীদের অবশ্যই নিজেদের নৈতিকতা, সততা, স্বচ্ছতা, মানবাধিকার ও সমতার মতো মূল্যবোধসমূহ বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার পরামর্শ দিতে চাই। তরুণ কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, কাজকে ভালোবাসতে হবে, এরমধ্যে দিয়েই জীবনে সফলতা আসবে। বর্তমান সময়ে বেসরকারি অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরে আর্থিক নিরাপত্তা অত্যধিক। তাই এখানে সফলতা পেতে হলে সকলকে মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার পাশাপাশি গ্রাহকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তাদের আস্থা ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। এটা দারিদ্র্য হ্রাস ও টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করার মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি লাভের এক অসাধারণ ক্ষেত্র।

পিকেএসএফ: আপনাকে ধন্যবাদ। আপনাদের সংস্থার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।

মনোয়ারা বেগম: আপনাকেও ধন্যবাদ। পিকেএসএফ কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা।